RSS

Category Archives: নববধূ সেজে উৎসবে নয়

নববধূ সেজে উৎসবে নয়, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা আমিনা


কপালে টিপ, পায়ে আলতা আর লাল শাড়ি পরে নববধূ সেজে উৎসব করার সৌভাগ্য হয়নি৷ হাতের মেহেদির রং মিলিয়ে না যেতেই বিয়ের মাত্র ১১ দিনের মাথায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আমিনা বেগম৷
‘‘বলতে গেলে সে সময় দেশের পরিস্থিতিই আমাকে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে নেয়৷ আর আমার স্বামী এ সময়ই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যান৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বহুবার বিভিন্ন স্থানে দেখা হয়েছে আমাদের৷ কিন্তু এসময় আমরা দু’জন অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো দেশের সম্ভ্রম বাঁচাতে এতটাই আন্তরিক ছিলাম যে আমাদের নিজেদের দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না৷” দীর্ঘ নয়মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের সক্রিয়তার কথা এভাবেই তুলে ধরলেন বীর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আমিনা বেগম৷
সিরাজগঞ্জে ১৯৫১ সালের ৩০ নভেম্বর জন্ম আমিনার৷ বাবা ডা. আনিসুর রহমান এবং মায়ের নাম জাকেরা বেগম৷ কলেজ জীবনের শুরু থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আমিনা৷ ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন৷ সেসময় সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদিকা৷ পরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন৷ ফলে হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি পটভূমি তৈরির কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আমিনা এবং তাঁর সহকর্মী ছাত্র নেতারা৷ সেই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য সকলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমিনা৷
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের ১৪ তারিখ তৎকালীন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক বকুলের সাথে বিয়ে হয় আমিনার৷ বিয়ের ১১ দিনের মাথায় পঁচিশে মার্চ জাতির জনকের উচ্চারিত শব্দমালা শুনে তাড়িত হন তাঁরা৷ স্বামী সংসারের হাতছানি দূরে ঠেলে উভয়েই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ কাজ করেছেন
ডয়চে ভেলের সাথে টেলিফোন আলাপে মুক্তিযুদ্ধে নিজের সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরেন আমিনা৷ তিনি বলেন, ‘‘সিরাজগঞ্জের প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা এবং পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের প্রায় দেড় হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য নির্দেশ আসে৷ সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নৌকাযোগে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের শিলিগুড়ির পাঙ্গা চর থেকে অস্ত্র কিনে আনবে৷ চারটি নৌকা নিয়ে আমরা মাইনকারচরের উদ্দেশ্যে রওনা করি৷ এর মধ্যে একটি নৌকার আরোহী ছিলাম আমি একা৷ মাঝপথে যাত্রীবোঝাই একটি নৌকায় দেখা মেলে আমার শিক্ষয়িত্রী জ্যোৎস্না দিদি ও তাঁর দেড় বছরের শিশুকন্যা সঞ্চিতার সঙ্গে৷ নানা দিক ভেবে আমি এ দুজনকে আমার নৌকায় তুলে নিই৷ এর কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানি দুটি গানবোট আমাদের পিছু ধাওয়া করে৷
এক পর্যায়ে আরেক নৌকায় থাকা আমার স্বামী আমাকে অস্ত্র সরবরাহকারীদের নাম-ঠিকানা দিয়ে আমাদের নদীর পাড়ে নামিয়ে দেন৷ চুক্তি হয়, প্রয়োজন হলে তিনি গ্রেনেড হামলা চালাবেন পাকিস্তানি গানবোটের ওপর, আর আমি ও জ্যোৎস্না দিদি যেকোনো মূল্যে অস্ত্র আনতে ভারতের শিলিগুড়ি যাব৷ দীর্ঘ পথ দৌড়ে আমরা একটি গ্রামে এসে পৌঁছাই৷ উত্তেজনার পাশাপাশি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তখন আমরা কাতর৷ দীর্ঘ সময় পর এক কিশোরী গৃহবধূ আমাদের কিছু মুড়ি ও পানি খেতে দেয়৷ সন্ধ্যায় আমরা নৌকাঘাটে এসে দেখি, আমার স্বামী উৎকণ্ঠিত হয়ে আমাদের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন৷ তাঁর কাছে শুনেছি, পাকিস্তানি গানবোট দুটি খুব কাছে এলেও পরিত্যক্ত নৌকা ভেবে ফিরে গেছে৷ গভীর রাতে আমরা মাইনকারচরে পৌঁছাই৷
পরদিন সড়কপথে আমরা জলপাইগুড়ির পাঙ্গা চরে যাই৷ পরে আমরা ট্রাকযোগে সেখান থেকে ৪০০ রাইফেল, ৪০ হাজার গোলাবারুদ, ১০ ব্যাগ বিস্ফোরক, চারটি আরসিএল এবং কিছু গ্রেনেড নিয়ে আসি৷ মাইনকারচর থেকে অস্ত্রগুলো আমরা তিনটি নৌকা বোঝাই করে সিরাজগঞ্জে নিয়ে আসি এবং সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করি৷”
এরপর রৌমারি ইয়ুথ ক্যাম্পে সিরাজগঞ্জের বেশ কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা দলের হয়ে যোগাযোগ এবং অস্ত্র সরবরাহের কাজ করেছেন৷ অক্টোবর মাসে শিলিগুড়ির পাঙ্গা চর থেকে আরো এক চালান অস্ত্র মাইনকারচরে এসে পৌঁছায়৷ এ সময় বেশ কিছু অস্ত্র নৌকাযোগে সিরাজগঞ্জে পাঠানো হয়৷ এর কিছুদিন পরই আমিনার উপর দায়িত্ব পড়ে, আরো কিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে৷ কিন্তু অস্ত্র নিয়ে নৌকাযোগে সিরাজগঞ্জ শহরের কিছুটা উত্তরে ব্রহ্মগাছায় পৌঁছালে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়৷ এ যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও যুদ্ধের পুরো সময় তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই৷ এক পর্যায়ে অস্ত্রসহ ফিরে আসেন৷ পরে কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারচরে গিয়ে অস্ত্র ও গ্রেনেডগুলো মাটিতে পুঁতে রাখেন৷ নির্দেশ ছিল, বিশেষ প্রয়োজনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে অস্ত্রগুলো সরবরাহ করতে হবে৷
স্বাধীনতার পর উপজেলা নারী ও শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন আমিনা৷ ২০০৮ সালে অবসরে যান৷ কিন্তু যুদ্ধের পরেও দেশের মানুষের জন্য, তাঁর ভাষায়, আরো দুঃসাহসী কাজ করেন তিনি৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সম্ভ্রমহারা নারীদের অর্থাৎ বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে একত্রিত করেছেন৷ তাঁদের অধিকারের জন্য এখন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন আমিনা৷ বীরাঙ্গনাসহ যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনও মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত এবং অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠী এবং সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি৷