RSS

Category Archives: বাংলা কম্পিউটিং

বাংলা ভাষা, ব্যবহার, বাংলা কম্পিউটিং এবং বঙ্গানুবাদ প্রসঙ্গে

“যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন ।
যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি ।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে না যায় ।”
– আব্দুল হাকিম
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। একদিন এই ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছিলাম আমরা। যারা অকাতরে এই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করা আমাদের অতীব প্রয়োজন। কিন্তু কিভাবে? আমাদেরো কি একিভাবে প্রাণ দিতে হবে? না। আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আজ প্রাণ দিয়ে প্রমান না করেও কিন্তু আমরা অন্যভাবে আমাদের প্রিয় ভাষার প্রতি যথার্থ মর্যাদা এবং সম্মান দেখাতে পারি।
দৈনন্দিন জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, লেখাপড়ায়, খবরের কাগজে, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিতে সঠিক এবং শুদ্ধ বাংলার প্রয়োগ চাই। আজকাল আমাদের মাঝে, বিশেষ করে তরুন সমাজে ভয়ানকভাবে প্রতিবেশী এক ভাষার যথেস্ট অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এখন থেকেই যদি এটা প্রতিহত করা সম্ভব না হয়, তবে অচিরেই অনেকাংশে ওই বিদেশি ভাষা আমাদের বাংলা ভাষাকে স্থানান্তর করে ফেলবে। আমি ইংরেজির মত আন্তর্জাতিক ভাষার কথা বলছিনা কিন্তু। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হলেও একিভাবে আমি তার অনুপ্রবেশের সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতাম। তাই বলে আমি ইংরেজি ভাষা শেখার বিরুদ্ধে বলছিনা। আধুনিক বিশ্বে কেবলমাত্র একটা ভাষা জেনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই অবশ্যই আমাদের ইংরেজি শেখার প্রতি জোর দিতে হবে, কিন্তু তার জন্য মাতৃভাষাকে পিছু ফেলে নয়, মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে নয়। আজকে যেটা হচ্ছে, বাংলা বাদ দিয়ে অনেককেই দেখা যাচ্ছে অযথাই প্রতিবেশী ঐ ভাষার প্রয়োগ করছেন যা কেবল আত্মসম্মান সম্পন্ন এবং বিবেকবান ব্যাক্তিদের বিরক্তির উদ্রেক করে। আরো আফসোসের কথা হলো, আমাদের নিজস্ব রেডিও, টিভি মাধ্যমগুলোতেও এটি অনুপ্রবিস্ট হয়েছে। এটা বাঙ্গালী জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ভীষন দুঃখজনক। আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি কিছুদিন আগে বাংলাদেশ বেড়াতে এলে এক বিরল(!) অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। চট্রগ্রামের ফয়েজ লেকের মত জাতীয় একটি ভ্রমন আকর্ষণ কেন্দ্রে মাইক দিয়ে, উচ্চস্বরে লাউড স্পীকারে সেই ভাষায় কুরুচিপুর্ণ গান বাজানো হচ্ছিলো। আর বিপনীবিতানগুলোতেও একি অবস্থা। যেকোন ক্যাসেট, সিডির দোকানে গেলেই হবে। বাংলা গানের এতই মন্দা বাজার? এরপর আবার ঢাকা-চট্রগ্রাম বাসেও একি অভিজ্ঞতা। আমার কেবলি মনে হচ্ছিলো, আমি কি আসলেই বাংলাদেশ এলাম নাকি অন্য কোন দেশে চলে এসেছি? ভাবলাম এই কি আমাদের অগ্রগতি? নিজস্ব সব জলাঞ্জলি দিয়ে অন্ধভাবে অন্যকে অনুসরণ করে চলেছি? আমাদের আর রইলো কি? বেশতো, নিজস্ব স্বকীয়তাটাই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি, তাই এখন থেকে আর বাঙ্গালী বলে নিজেকে পরিচয় না দিলেই হয়। বাঙ্গালীত্বের কিছু না রেখে নিজেকে বাঙ্গালী বলে চালিয়ে দেয়া অপমানজনক। এখন থেকে আর বছরে দু’একবার ভন্ডামী করা লাগবেনা, স্মৃতিসৌধে, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আবারো বছর বছর বাঙ্গালী বাবু সাজা লাগবেনা।
ভিনদেশী যেকেউই আমাদের এ ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক দুরবস্থা দেখে আমাদের করুনা করবেন বৈকি।
এবারে আসা যাক প্রযুক্তি প্রসঙ্গে। ধীরে ধীরে আমরাও এগুচ্ছি, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের প্রবেশ ঘটছে যা অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে অদুর ভবিষ্যতে। বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ ভাষা হওয়া সত্বেও আজো বিভিন্ন সফটওয়্যার এর বাংলায় অনুদিত সংস্করন পাওয়া দুস্কর। আশার কথা হলো এই যে আজকাল অনেকে এগিয়ে আসছেন। বিভিন্ন ওপেন সোর্স সফটওয়্যারগুলোর যথাসম্ভব বাংলায় অনুবাদ করার চেস্টা করছেন। এছাড়াও বাংলায় লিখার জন্য তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ফোনেটিক কি-বোর্ড। এমনকি প্রায় সম্পুর্ণ বাংলায় আজ লিনাক্স সিস্টেমও পাওয়া যায়। অনলাইনেও দেখবেন বাংলায় নতুন নতুন অনেক ওয়েব সাইট তৈরি হচ্ছে। এসব উদ্দ্যোগকে এবং জড়িত সবাইকে আমি আন্তরিকভাবে স্বাগতম জানাই এবং অন্যদের কাছে অনুরোধ করি যে যেভাবে পারেন, সবাইকে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাবার জন্য। প্রযুক্তিতে আমাদের যত বিস্তার ঘটবে, ততই অগ্রগতি তরান্বিত হবে। সবার এসব সম্মিলিত প্রচেস্টা আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে।
আমি নিজেও ব্যাক্তিগতভাবে অপেরা ব্রাউজার এবং ইনভিশন পাওয়ার বোর্ড সফটওয়্যার বাংলায় রুপান্তর করার কাজ শুরু করেছি। কিন্তু কিছুদুর এগিয়ে এক সমস্যার সম্মুখীন হলাম। আমি নিশ্চিত আমি এখানে একা নই। অন্য যারা বাংলায় রুপান্তর করেছেন পূর্বে, তারাও একি বিপাকে পড়েছিলেন। বাংলা ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের জন্য, যোগাযোগের জন্য, লেখালেখির জন্য যথেস্ট শব্দ সমাহার রয়েছে। কিন্তু আপনি আধুনিক প্রযুক্তিগত শব্দের যথার্থ বাংলা খুঁজে পাবেন না। প্রায় সব এপ্লিকেশনে আপনি “টুলস” মেনু খুঁজে পাবেন। আমি উদাহরণস্বরুপ Tools এর প্রতিশব্দ উল্লেখ করছি এখানেঃ
(Bangla Academy English-Bengali Dictionary, 29th Reprint, July 2005, ISBN – 984-07-4497-6), পৃষ্ঠা – ৮৩৫ থেকে-
Tool – হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি, অসদুদ্দেশ্যে ব্যাবহৃত ব্যাক্তি ; হাতিয়ার, হাতিয়ার দিয়ে কোনো কিছু (যেমন বইয়ের প্রচ্ছদ) অলঙ্কৃত করা।
(বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পঞ্চম পুনর্মুদ্রন, ভাদ্র ১৪১০, আইএসবিএন-984-07-4402-X), পৃষ্ঠা – ১২০২ থেকে-
হাতিয়ার – হাতে বহন করা যায় এমন অস্ত্রশস্ত্র, শিল্পসাধন যন্ত্র, হস্ত দ্বারা ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় অস্ত্রাদি।
এখানে প্রশ্ন হলো, আমি যদি বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে শব্দচয়নে যদি এ ধরনের আক্ষরিক বা আভিধানিক অর্থ দিয়ে ভাষান্তর করি, তাহলে এর ফলাফল কি হতে পারে? কোন শব্দটা শ্রুতিমধুর হবে? কোন ক্ষেত্রে অভিধান ব্যবহার করা প্রয়োজন? কোন ক্ষেত্রে সরাসরি কোন ইংরেজী শব্দের বাংলা না খুঁজে সেটাকে অটুট রেখে বরং বাংলা অক্ষরে লিখলে ভালো হতে পারে? অর্থাত, এই “Tools” কে “যন্ত্রপাতি” হিসেবে না লিখে “টূলস” লিখে রাখলে কেমন হবে? এ ধরনের আরো অনেক হাজারো ইংরেজি, বিশেষ করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, আছে যেগুলোর বাংলা পাওয়া মুস্কিল। এরকম অহরহ শব্দ না থাকাটা আপনার, আমার কারো দোষ নয়। দোষ নয় বাংলা ভাষারো। কারন অনেক শব্দই হটাৎ করেই উদ্ভাবিত হয়। যেমন – গুগুল হলো একটা নাউন, অথচ আমরা এটাকে আজকাল ভার্ব হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছি। “Podcasting”, এটাও কোন যথার্থ ইংরেজী শব্দ নয়, অথচ আজকাল ইংরেজীর সাথে জুড়ে গেছে। এই শব্দের বাংলা পাবো কোথায়? তাহলে উপায়? উপায় একটাই। এটাকে “পডক্যাস্টিং” হিসেবেই লিখতে হবে। এটা ছাড়াও আরেকটা সমস্যা আছে এরুপ আক্ষরিক অনুবাদের। যেমন ধরুন নিন্মের কাল্পনিক চিত্রটি-
– হ্যাঁ, তুমি টুলস এ টিপ দাও, দিয়ে ইন্টারনেট অপশন মেনু দেখো
– টুলস? আমিতো টুলস দেখিনা। এখানে আছে ফাইল, সম্পাদনা, দেখা, পছন্দনীয়, যন্ত্রপাতি, সাহায্য
– আচ্ছা, যন্ত্রপাতিতে টিপ দাও দেখি, তারপর অপশন দেখো
– দিলাম টিপ, কিন্তু অপশন তো নেই এখানে? আন্তর্জাল ইচ্ছাসমুহ তে?
– হ্যাঁ!
দেখতে পাচ্ছেন কি সমস্যা হতে পারে। এর কারন হলো সার্বজনীনভাবে গৃহীত এসব ইংরেজী শব্দের বাংলা নেই। তাই এক অনুবাদকের করা বাংলা আরেক অনুবাদকের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে। যেমন আমি অপেরা ব্রাউজারে Tools কে টুলস হিসেবে লিখলাম, আপনি ফায়ারফক্সে টুলস কে যন্ত্রপাতি হিসেবে লিখে থাকেন, তাহলে মাঝখান থেকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে আমাদের অনুবাদের ব্যবহারকারীরা। একেকজন অনুবাদক একেক শব্দ বাছাই করে অনুবাদ করতেই পারেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমরা উভয়েই একি ইংরেজী শব্দের ভিন্নরকম বাংলা করছি। এটা এড়ানোর জন্য উপায় একটাই এবং সেটা হলো যেসব ইংরেজীর ভালো এবং সহজ বাংলা নেই, তাকে অনুবাদ এড়িয়ে যাওয়া। ব্যবহারকারীরা যদি দেখেন এক এপ্লিকেশনে কেউ টুলস’এর বদলে লিখেছে যন্ত্রপাতি এবং আরেক এপ্লিকেশনে টুলসের বদলে লিখা হয়েছে হাতিয়ার।
আমি মনে করি এতে হিতে বিপরীত হবে। তখন বাংলায় তাদের আগ্রহী করাতো দুরে থাক, ভাষা নিয়ে এসব সংশয়, জটিলতা এবং দ্বিধার কারনে তারা হয়তো বাংলায় অনুদিত সফটওয়্যার ব্যবহারই করবেন না একদম। তাহলে অনুবাদকদের কি করা উচিত? এক কথায় আমি বলবো ভালো এবং বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারবে, এমন প্রতিশব্দ না থাকলে সেটাকে ইংরেজিতেই রেখে দিন, তবে বাংলা অক্ষরে লিখে দিন ইংরেজি শব্দটা।
এবারে অনেকে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবেন হয়ত। বলবেন শুরুতে কি সব বড় বড় কথা ভাষা নিয়ে, অথচ শেষে এসে বলছে বাংলার বদলে ইংরেজী লিখতে? আমি উত্তরে বলবো, আপনার মনে যদি ঠিক এই প্রশ্ন জাগরিত হয়, তবে আপনি সম্পুর্ণরুপে এই প্রবন্ধের সারমর্ম অনুধাবন করতে ব্যার্থ হয়েছেন। কথ্য ভাষায় কথা বলা অপরাধ নয়। আমি এও বলছিনা সবাইকে এখন থেকে শুদ্ধ ভাষায়, সাহিত্যিক ভাষায় কথা বলা শুরু করতে হবে এবং এতেই ভাষার প্রতি মর্যাদা দেখানো হবে। অনুরোধ শুধু নিজ ভাষার প্রতি অনীহা করবেন না। তা সে দৈনন্দিন জীবনে হোক, বা কম্পিউটারে হোক।

যুগের পরিবর্তনের সাথে আমাদের খাপ খাওয়াতে হবে, তবে তা স্বকীয়তার মূল্যে নয়, ভাষাকে, নিজের সংস্কৃতিকে অবমাননা করে নয়। নিজেকে হেয় করে কেউ বড় হতে পারেনা। আসুন বাংলায় লিখি, কথা বলি, বাংলা ছড়িয়ে দেই সর্বত্র এবং অপভাষাকে প্রতিহত করি। কাল নয়, পরশু নয়, সময় আজ, এক্ষুনি।