|
| |
 |
বাংলাদেশের এক দ্বীপ জেলা ভোলা৷ ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রাম৷ এই গ্রামেরই সন্তান হাবিবুর রহমান৷ তিনি সেনাবাহিনীর হাবিলদার৷ থাকেন কুমিল্লা সেনানিবাসে৷ গ্রামে তিনি হাফিজ মিলিটারি নামে পরিচিত৷ সরকারি ছুটিছাটায় হাবিবুর রহমান যখন গ্রামে আসেন তখন তাঁর সাথে থাকেন স্ত্রী মালেকা বেগম ও দুই সন্তান মোস্তফা কামাল এবং মোস্তাফিজুর রহমান৷ এই বাপ-দাদার ভিটেয় কেউ তাঁকে আর হাবিবুর রহমান ডাকে না৷ সবাই তাঁকে ডাকে হাফিজ মিলিটারি নামে৷ এই ডাক ছেলে মোস্তফা কামালের মনে এক মধুর অনুরণন তোলে৷ এই ডাক শুনে শুনে অল্পবয়সী মোস্তফা কামাল নিজের মনেই ঠিক করে ফেলেন বড় হয়ে পিতার মতোই তিনিও হবেন একজন সৈনিক৷ ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই মোস্তফা কামাল৷ ছেলেবেলায় ছিলেন খুব ডানপিটে স্বভাবের৷ তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে কুমিল্লা সেনানিবাসে পিতার সরকারি আবাসে৷ সেনানিবাসের সাজানো গুছানো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর দিন কেটে যায়৷ স্কুল ফাঁকি দিয়ে মোস্তফা কামাল ঘুরে বেড়ান সৈনিকদের ছাউনিতে৷ স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে মোস্তফা কামালের ভালো লাগে সৈনিকদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট৷ আর অন্য সৈনিকদের মতো একজন দীপ্ত সৈনিক হওয়ার জন্য নিজে নিজে তৈরি হতে থাকেন ৷ কিন্তু পুত্রের এই ইচ্ছেয় বাধ সাধেন পিতা৷ পিতা চাননি তাঁর ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিক৷ ফলে ২০ বছর বয়সে মোস্তফা কামাল একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে হঠাত্ নিরুদ্দেশ হয়ে যান৷ কোথাও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ এই নিরুদ্দেশের দিনগুলোতে তিনি চুপিচুপি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷ ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর চাকুরি চূড়ান্ত হওয়ার পর পিতা-মাতা তাঁর সন্ধান পান৷
১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাঠানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৷ তখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ৷ স্বাধীনতার দাবিতে সারাদেশ উত্তাল৷ প্রতিটি সেনানিবাসে থমথমে অবস্থা৷ বাঙালি সামরিক অফিসারদের চেয়েও অধিক ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, উদ্বেলিত উত্তেজিত ছিল বাঙালি সিপাহীরা৷
সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর অবাঙালি অধিনায়কেরা বিভিন্ন বাঙালি রেজিমেন্টকে একস্থান থেকে আরেকস্থানে স্থানান্তর করছিল৷ এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে৷ কিন্তু উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়৷ মেজর শাফায়েত জামিল (পরবর্তীতে কর্নেল ও অবসরপ্রাপ্ত) কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসারের সহায়তায় ২৭ মার্চের সকালবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সে’সময়ের অবাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান এবং সমস্ত পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানদের নিরস্ত্র করে বন্দি করে ফেলেন৷ অপরদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ অন্য একটি কোম্পানি নিয়ে সিলেটের শমসেরনগর থেকে বিদ্রোহে যোগ দেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন৷
স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেয় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট৷ মোস্তফা তখন চব্বিশ বছরের দীপ্ত তরুণ৷ চার বছর যাবত্ কাজ করছেন সেনাবাহিনীতে৷ তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর আচরণ৷ রেডিওতে শুনেছেন ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ৷ স্বাধীনতার স্বপ্নে তাঁর দু’চোখ জ্বলে ওঠে৷ ঘরে ছিল তাঁর তরুণী বধূ, সদ্যজাত শিশুপুত্র৷ ছিল ভাই-বোন, মা-বাবা, পিতামহী৷ সকলের মায়া ত্যাগ করে দেশ ও স্বাধীনতার এক বিপুল প্রেমে যোগ দেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে৷ সেদিন যেসব উত্ফুল্ল সিপাহী ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে আকাশমুখে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জয়োল্লাসে মত্ত হয়েছিলেন, সিপাহী মোস্তফা কামাল ছিলেন তাঁদের মধ্যভাগে৷ ফাঁকা গুলি ছোড়া দেখে মেজর শাফায়েত সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশারোপ করেন যেন আর একটি গুলি বিনা কারণে নষ্ট না করা হয়৷ কারণ প্রতিটি গুলিই মহামূল্যবান হয়ে উঠছে আগামী সময়ের জন্য৷ ফলে বন্ধ হয় ফাঁকা গুলি ছোড়ার উত্সব৷
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি৷ আশুগঞ্জ, উজানীস্বর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এন্ডারসন খালের পাশে এসব প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়৷ আশুগঞ্জের প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে দুই কোম্পানি সৈন্য এবং অন্য দুটোতে একটি করে কোম্পানি৷ এ সময় রেজিমেন্টে যোগ দিতে থাকেন ছাত্র, চাকরিজীবী, কৃষক, মজুর, বিডিআর, পুলিশসহ সর্বস্তরের স্বাধীনতাকামী বাঙালি৷ ১৪ এপ্রিল ১৯৭১৷ পাকিস্তানি মিলিটারি একযোগে হেলিকপ্টার গানশিপ, গানবোট এবং এফ-৮৬ স্যেবার ফাইটার বোম্বার বিমান নিয়ে আশুগঞ্জ এবং এন্ডারসন খালের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি দুটোতে আক্রমণ করে৷ নয় ঘন্টা ধরে একযোগে যুদ্ধ চলার সময় পাকিস্তানি বাহিনী বিমান থেকে বোমা ফেলে, নেভাল গানবোট থেকে গোলা ছোঁড়ে, হেলিকপ্টারযোগে প্যারাসুট পরে সৈন্য নামিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে৷ এমন আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র একেবারেই মামুলি৷ আশুগঞ্জের ঘাঁটির পেছনেই হেলিকপ্টার দিয়ে অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য নামানো হলো৷ মুক্তিবাহিনী কৌশলে পশ্চাদপসরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলপথ ধরে চলে এল আখাউড়ায়৷ এই আখাউড়াকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে মোট তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হলো৷ তিতাস নদীর ব্রিজে, আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এবং তার উত্তরে দরুইন গ্রামে৷ ইতিমধ্যেই মোস্তফা কামালের সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতত্পরতা মুগ্ধ করে মেজর সাফায়াত জামিলকে ৷ তিনি তাঁকে ২নং প্লাটুনের ল্যান্সনায়েক নির্বাচিত করেন৷ সে অনুসারে মোস্তফা কামাল দশজন সৈন্যের সেকশন কমান্ডার হন৷ এই ২নং প্লাটুনকেই দরুইন গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব দেওয়া হলো৷
মোস্তফা কামাল বিশ্বাস করতেন, সৈনিকদের শক্ত মনোবল, সাহসই এক-একটি দুর্গ৷ এই বিশ্বাসে নিবদ্ধ হয়ে মাত্র দশজন সৈন্য নিয়ে তিনি দরুইন গ্রামে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব নিলেন৷ এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের অবস্থা একেবারে মুমূর্ষু৷ তাঁরা শুধু উন্মাদের মতো যুদ্ধ করেই যাচ্ছে৷ এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতেই খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি৷ দুদিন পেটের ক্ষুধা নিয়ে শত্রুর মহুর্মহু আক্রমণ সামলানো ঘাঁটির সৈন্যদের জন্য একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল৷
যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ও খাবার সংগ্রহের জন্য মোস্তফা কামাল নিজেই দরুইন গ্রাম থেকে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর আখাউড়ায় এলেন৷ তাঁকে দেখেই ক্ষুব্ধ হলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল৷ অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘একি! তুমি কেন এসেছ তোমার প্রতিরক্ষা ছেড়ে? তুমি না সেকশন কমান্ডার? তোমার ঘাঁটি ছেড়ে আসাটা খুব অন্যায় হয়েছে৷ নিজে না এসে কোনো সিপাহীকে পাঠালেই তো এ কাজ হতো৷’
মোস্তফা কোনো কথা বললেন না৷ নিজেই নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করলেন৷ তাঁর মনে হলো, এমন ভয়ংকর যুদ্ধের সময় নিজের ঘাঁটি ছেড়ে আসাটা তাঁর মোটেও ঠিক হয়নি৷ খাবার সংগ্রহ এবং যুদ্ধের সঠিক পরিস্থিতি জানার জন্য নিজে আসার চেয়ে কাউকে পাঠালেই হয়তো ভালো হতো৷ কারণ সে সেক্টর কমান্ডার৷ একটা ভুল মনস্তাপে ভুগতে থাকেন মোস্তফা৷ সাথে সাথে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, কখনোই নিজ পরিখা ত্যাগ করবেন না৷
১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকল৷ একটাই উদ্দেশ্য চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে নেয়া৷ ১৭ এপ্রিল সকাল থেকেই শুরু হয় দরুইন গ্রামে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ২নং প্লাটুনের ওপর আর্টিলারি গোলাবর্ষণ৷ মাত্র দশজন সৈন্য নিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানি সৈন্যদের মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব৷ মোস্তফা সেক্টর প্রধানের কাছে সংবাদ পাঠালেন বাড়তি সেনা সহায়তার জন্য৷ চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন৷ আত্মরক্ষার জন্য প্লাটুনের সবাই অবস্থান নেয় পরিখার ভেতর৷ দুপুরের দিকে হাবিলদার মুনির আহমেদের নেতৃত্বে ১১নং প্লাটুন দরুইন গ্রামে এসে পৌঁছাল৷ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস এল দরুইনের নিরাপত্তা ঘাঁটিতে৷ শেষ রাতের দিকে হানাদার বাহিনীর গোলাবর্ষণ কিছুটা কমে আসে৷ তবু সবাই সারারাত জেগে থাকল৷
১৮ এপ্রিল ভোরবেলা৷ আকাশে উড়ে এল কালো মেঘের সারি৷ ঈশাণ কোণ থেকে আসতে লাগল শীতল বাতাস৷ মুক্তিযোদ্ধারা মনে মনে ভাবল, আসুক মেঘ, বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিক সব৷ তাহলে হয়ত শত্রুরা একটু দমে যাবে৷ সকালটা একরকম নির্বিঘ্নেই কাটল৷ পাকিস্তানি বাহিনী কোনোরকম গোলাবর্ষণই করল না৷ শুধু কয়েকটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল উজানীস্বর পুলের দিকে৷ খাবার এলেও মোস্তফা পরিখা থেকে উঠে এলেন না ৷ প্লাটুনের সবাই একে একে খাবার নিয়ে গেল৷ তিনি এলএমজি হাতে নিজের ট্রেঞ্জে অতন্দ্র, অনড়৷
বেলা এগারোটা৷ পাকিস্তানি বাহিনী আবার গোলাবর্ষণ শুরু করল৷ আর সাথে সাথেই শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি৷ কিন্তু বৃষ্টিকে অবজ্ঞা করেই এগিয়ে এল শত্রু৷ আধঘন্টার মাঝে অবস্থান নিল মোগরা বাজার ও গঙ্গাসাগরে৷ সাড়ে এগারোটায় এ দুটো অবস্থান থেকে আসতে লাগল অনবরত গুলির ধারা৷ মোগরা বাজারের একটি উঁচু দালানের ছাদে শত্রুরা বসাল একটি মেশিনগান৷ আর এ থেকেই মারাত্মকভাবে দরুইনের ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল৷
বেলা বারোটায় আক্রমণ হলো তীব্রতরভাবে৷ পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এবার সরাসরি আক্রমণ করে বসল৷ মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা গুলি তার সামনে কিছুই ছিল না৷ তার উপর আবার একটা গুলি এসে বিদ্ধ করল মেশিনম্যানকে৷ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল মেশিনগান৷ মোস্তফা মুহুর্ত দেরি না করে মেশিনগানটি হাতে তুলে নিয়ে গুলি চালাতে লাগলেন৷
দুপুরের পর পাক হানাদারের আক্রমণ আরও তীব্রতর আকার ধারণ করল৷ প্রবল বৃষ্টির কারণে তাদের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে এমনটি ধারণা করছিল মুক্তিযোদ্ধারা৷ ফল উল্টো হওয়ায় তাঁরা সামান্য হতবিহ্বল হয়ে পড়েন৷ তবে সেকশন কমান্ডার মোস্তফার অবিচলিত মনোভাব ফের তাঁদের আত্নবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে৷
পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশি৷ সঙ্গে তাদের বিপুল অস্ত্রের ভাণ্ডার৷ তারা দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে দরুইনকে প্রায় ঘিরে ফেলল৷ তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় একেবারে নগণ্য৷ ভারী অস্ত্র নেই বললেই চলে৷ এই অবস্থায় কৌশল গ্রহণ করতে হলো- প্রথমত সামনা-সামনি যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা দ্বিতীয়ত পূর্বদিকে পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া৷ পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্তই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো তাঁদের কাছে৷ কিন্তু পিছু হটতে হলেও তো কিছুটা সময় প্রয়োজন৷ পিছু হটার সময় কাভার দেবে কে? কিন্তু পিছু না হটলে সবার মৃত্যু অবধারিত৷ মোস্তফা কামাল স্থির করলেন তিনিই কাভারিং ফায়ার দেবেন৷ এই উদ্দীপ্ত, তারুণ্যের প্রতীক, তেজি সংগ্রামী মানুষটি নিজে পরিখার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন৷ একাই গুলি চালাতে লাগলেন উত্তরে, দক্ষিণে, পশ্চিমে৷ মোস্তফা নির্দেশ দিলেন সবাইকে পিছু হটার জন্য৷ কিন্তু তাঁকে রেখে অন্যরা যেতে চায় না৷ মোস্তফা বললেন, কেউ একজন কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব না নিলে বাকি সবাইকে মরতে হবে৷ সেকশন কমান্ডার হিসেবে এটা আমারই দায়িত্ব৷
মোস্তফা কামালকে দুর্গের মধ্যে রেখেই বাকিরা খুব সাবধানে পিছু হটতে লাগলেন৷ মোস্তফা অনবরত গুলি চালাতে লাগলেন শত্রুদের ওপর৷ তাঁর গুলির তোড়ে হানাদার বাহিনী এগোতে গিয়ে থামতে বাধ্য হলো৷ এবার অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সরে আসার জন্য অনুরোধ জানান৷ কিন্তু মোস্তফা মনস্থির করে ফেলেছেন৷ তিনি অনড়, অদম্য, নিজেই এক বিশাল দুর্গম দুর্গ৷ তাঁকে ভেদ করবে একমাত্র মৃত্যু৷ ক্রমাগত গুলি চালাতে লাগলেন শত্রুর ওপর৷ কিন্তু বিধি বাম, একসময় তাঁর গুলি ফুরিয়ে গেল৷ হানাদার বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণে তাঁকে ঘিরে গুলি চালাতে লাগল৷ গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল মোস্তফার শরীর৷ নিজের পরিখাতেই ঢলে পড়েন তিনি৷ তাঁর এমন বীরত্বের কারণেই অন্য সহযোদ্ধারা বেঁচে রইলেন আগামী সময়ে যুদ্ধ করার জন্য৷
দরুইন গ্রাম থেকে পশ্চাদপসরণ করে মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চলে যান৷ মেজর শাফায়েত জামিল তাঁদের নিয়ে ভারত সীমান্তে মনতলায় চলে যান৷ গঙ্গাসাগর ও দরুইন অধিকার করে একসময় পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে যায়৷ পরবর্তীতে দরুইনের স্থানীয় লোকেরা বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটবিদ্ধ মোস্তফা কামালের লাশ খুঁজে পান৷ হানাদার বাহিনী যখন ট্রেঞ্জে প্রবেশ করে তখনও হয়তো মোস্তফার দেহে প্রাণ ছিল৷ বর্বর হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েই হয়তো তাঁকে হত্যা করেছে৷ দরুইনের মাটিতে শায়িত আছেন এই বীর৷ তাঁর অদমনীয় মানসিক দৃঢ়তা ও নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যদের বাঁচিয়ে দেয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অমর গৌরবগাথা৷ আর এ জন্যই তিনি পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা৷
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্মস্থান ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামে হলেও তাঁর নামে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার হচ্ছে ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামে৷ কেননা হাজিপুর গ্রামটাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে৷ পাশাপাশি সরকার আখাউড়ায় স্থাপন করেছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি কমপ্লেক্স৷ ২০০৩ সালে মা মালেকা বেগম পুত্রের শেষ আশ্রয়স্থলটি পরিদর্শন করে এসেছেন৷ তিনি এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘বারবার ছুটে যেতে মন চায়, কিন্তু শরীর অসহায়৷ ছেলে দেশের জন্য শহীদ হইল৷ দেশের মানুষের লগে আমারও গর্ব হয়৷ আমি একজন বড় শহীদের, বীরশ্রেষ্ঠর মা৷ আমার পাওনের আর কিছু নাই৷ তয় আমার পোলার সংসারটাও ভাগ্যে লাগে নাই৷ বেবকই দুনিয়া ছাড়ল৷’ বীরশ্রেষ্ঠর নামে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণের কাজ চলছে৷ জেলা পরিষদ প্রায় সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে এই কমপ্লেক্স৷
মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা এখন মৌটুপী গ্রামে বসবাস করেন৷ ল্যান্স নায়েক মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের নামানুসারে মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে কামালনগর৷ মোস্তফা কামালের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কেউই বেঁচে নেই৷ মা ছাড়া আর আছেন একটিমাত্র ভাই মোস্তাফিজুর রহমান৷
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
জন্মস্থান : ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে৷
পিতা : হাবিবুর রহমান মণ্ডল৷
মা : মোসাম্মত্ মালেকা বেগম৷
কর্মস্থল : সেনাবাহিনী৷
যোগদান : ১৯৬৮ সাল৷
পদবী : সিপাহী৷
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ৮ নং সেক্টর৷
মৃত্যু : ৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল৷
সমাধি স্থল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে৷ |
|
|
ফোকাস বাংলা 