RSS

Category Archives: ২১ মার্চ ১৯৭১ : তোফায়েল আহমেদ

২১ মার্চ ১৯৭১ : তোফায়েল আহমেদ

লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২০তম দিবস আজ অতি-বাহিত হয়। ১৯৭১-এর ২১ মার্চের এ দিনটি ছিল রবিবার। যে সকল অফিস খোলা রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশ দিয়েছিলেন সেগুলো ছাড়া আর সব সরকারী-আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে অসহযোগ কর্মসূচী নিয়মতান্ত্রিকভাবেই পালিত হয়। যথারীতি আজও রাজধানীর সকল সরকারী-বেসরকারী বাস-ভবন এবং যানবাহনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী এবং বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগের সমর্থনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণ সংগঠনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও শেস্নাগানে রাজধানীসহ সারা দেশের রাজপথ আগের মতই প্রকম্পিত থাকে। আজ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তাঁর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। মিঃ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুকে এমনকিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তৎক্ষণাৎ সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “আমি আমার জনগণকে পাকিস্তানের শেয়ালদের হাত থেকে মুক্ত করে আমেরিকান বাঘদের হাতে তুলে দিতে পারি না।” অপরদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধু আজ এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় ৭০ মিনিট স্থায়ী আজকের বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে একমাত্র সহকমর্ী ছিলেন জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। অন্যপক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ছিলেন তার আইন উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস এবং সামরিক উপদেষ্টাগণ। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে রাগত স্বরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।” সাংবাদিকগণ আলোচনার ফলাফল জানতে নেতাকে চাপাচাপি করতে থাকলে তিনি আর কিছু বলতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে স্বীয় বাসভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বাসভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাগণের সাথে ৪টি শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওনারা আমার কাছে একটা কথাই বার বার বলছেন যে, আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসুক। আমি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছি, এতো কিছু হওয়ার পরে আমার কাছে ওই ৪ দফা ছাড়া আর অন্য কোন কথা নাই। আমি আমার জনগণের কাছে যা বলেছি, বার বার তাই আমি আপনাদের কাছেও বলছি। এ ভিন্ন আমার অন্য কোন কথা নাই। আলোচনা সফল করতে হলে এখন প্রেসিডেন্টকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” খুবই ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকগণের উদ্দেশে কথাগুলো বলছিলেন। সাংবাদিকদের একাধিক প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায়ে উত্তপ্ত স্বরে বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে এ কথাটি ছাপতে নিষেধ করে নেতা বলেন, “এটি অব দ্য রেকর্ড। কার সাথে আলোচনা করবো? গিয়ে দেখি কালা কুত্তা (বস্ন্যাক ডগ) মদ নিয়ে চুর হয়ে আছে।” 
আজও বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ছিল সারা দেশ থেকে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ-যুবক-শিশুদের পদভারে মুখরিত। তাদের প্রত্যেকেই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে উচ্চকণ্ঠে শেস্নাগান দিচ্ছিল। আগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবি পরিপূরণ না হওয়া পর্যন্ত সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে কোন প্রকার শৈথিল্য দেখানো যাবে না। আন্দোলন অতি অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের জনগণ আজ যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তা কোনভাবেই মলিন করা চলবে না।” স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার শেস্নাগানমুখর মিছিলের উদ্দেশে দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে একটি উপনিবেশ এবং বাজার বানিয়ে রাখার দিন শেষ হয়ে গেছে। এ জাগ্রত জাতিকে কেউ আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা আমাদের দাবীর বৈধতা প্রতিপন্ন করেই এগিয়ে যাবো।” এ সময় সংগ্রামী জনতা নেতার নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সংহতি ঘোষণা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গিকার ঘোষণা করে। এদিন পিপলস্ পার্টির প্রধান মি. ভুট্টো করাচি থেকে ঢাকা আসেন। ঢাকায় পৌঁছানোর সাথে সাথেই সংগ্রামী জনতা তার বিরুদ্ধে তুমূল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কড়া সামরিক নিরাপত্তায় তিনি হোটেলে পৌঁছান। মি. ভুট্টোর সাথে ছিল ১৩ জন উপদেষ্টা এবং প্রায় এক ডজন সশস্ত্র দেহরক্ষী। প্রেসিডেন্ট ভবনের ১০০ গজের মধ্যে অবস্থিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত ভুট্টো জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতে গেলে সংগ্রামী জনতা তার প্রতি জুতা নিক্ষেপ করে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। রাতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া দুই ঘন্টা স্থায়ী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন এবং ২৫ মার্চের গণহত্যার নীল নকশা চূড়ান্ত করেন। রাতে বিদেশী সাংবাদিকদের মি. ভুট্টো বলেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে।” অর্থাৎ জেনারেল ইয়াহিয়া খান গৃহীত গণহত্যা পরিকল্পনায় মি. ভুট্টো তার সম্মতি জ্ঞাপন করে বলছেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
অপরদিকে সন্ধ্যায় ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে পুনরায় দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে জনৈক সাংবাদিকের ভুট্টোর ঢাকায় আগমন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু নিরুত্তর থাকেন। বরং, তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠক প্রসঙ্গে বলেন, “এই বৈঠক আশ্চর্যজনক বা আকস্মিক কিছু নয়। প্রেসিডেন্ট ও আমি এখানে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ প্রয়োজনের স্বার্থে, যেকোন ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আমরা মিলিত হতে পারি।” এদিন পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনবিদ এ কে ব্রোহী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। প্রেসিডেন্টের সাথে আজকের আলোচনা ও মি. ভুট্টোর ঢাকা আগমনের মধ্যদিয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৪টি শর্ত সামরিক কর্তৃপক্ষ মানবে না। সুতরাং আমাদেরকে ১ দফা তথা পরিপূর্ণ স্বাধীনতার দিকেই এগিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক প্রস্তুতিপর্বের কাজ আমরা আগ থেকেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আজ বঙ্গবন্ধু আমাদের চার জনকে অর্থাৎ শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং আমাকে ডেকে আগামী ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে পাকিস্তান দিবসের বিপরীতে “লাহোর প্রস্তাব দিবস” পালন এবং সেদিন যেন বাংলাদেশের প্রতি ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে, আর সারাদেশে সাধারণ ছুটি পালিত হয়- সে প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। এই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু মুজিব ১৯৬৬-তে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দিয়েছিলেন_ অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব ছিল ৬ দফার উৎস স্থল। নেতার নির্দেশ মোতাবেক আমরা সারা দেশে গড়ে তোলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে এ বিষয়ে নেতার নির্দেশ প্রতিপালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ দিন নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় পরিপূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে এক অভিনব নৌ ও জাহাজ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। হাজার-হাজার নর-নারী “জয় বাংলা” শেস্নাগানে দশ-দিগন্ত মুখরিত করে এই বর্ণাঢ্য মিছিলে অংশগ্রহণ করে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করে, আলোচনা-বৈঠকে অংশগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় রাজনীতিতে মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলের নিকট আসন্ন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা সুনিপুণভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সর্বব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এখন এটি জাজ্বল্যমান বাস্তব সত্য হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত যে, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে বাংলার মানুষ বিগত কুড়ি দিন যাবৎ এক অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয়, সর্বাত্মক গণ-আন্দোলনে নিয়মতন্ত্রের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নজর কেড়েছে। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য হিসাবে দৃষ্টিগোচর হওয়ার অপেক্ষায়। এমতাবস্থায় দেশের এবং বিদেশের সকল স্তরের অগণিত মানুষ, রাজনৈতিক নেতা ও কমর্ীবৃন্দ এবং মুক্তিপিপাসু সকল বাঙালি অপার আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখের দিকে। কখন এবং কোন মাহেন্দ্রক্ষণে নেতার মুখ নিঃসৃত স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা শুনবেন। সংগ্রামী জনতা তাদের নেতার উপর এতো সুউচ্চ আস্থা স্থাপন করেছিল যে, নেতা যখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন তখন থেকেই তারা তা কার্যকর করার জন্য, প্রিয় মাতৃভূমিকে দখলদার মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে; কিন্তু তার আগে নেতার নির্দেশ শিরোধার্য জ্ঞান করে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই অসহযোগ চালিয়ে যেতে হবে; যাতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে কোন মহলই যেন বাঙালি জাতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করতে না পারে।