RSS

Category Archives: War 1971

মুক্তিযুদ্ধে পাক সাবমেরিন গাজী- শিকারে পরিণত হওয়া শিকারী

পিএনএস গাজী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ সাবমেরিন; ফ্ল্যাগশিপ মর্যাদা সেসব রণতরীই পায় যারা পুরো নৌবহরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যুদ্ধজাহাজ। সে হিসেবে ৭১ সালে গাজীর এই পদমর্যাদা ন্যায্য প্রাপ্য। যদিও গাজীর ডিজেল চালিত ইঞ্জিন নিঃসন্দেহে আধুনিক পরমানু শক্তি চালিত ইঞ্জিনের মত দক্ষ নয়, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে; বিশেষ করে প্রতি যাত্রায় ১ মাস বা ১১,০০০ মাইল পাড়ি দেবার দীর্ঘ ক্ষমতাসম্পন্ন গাজী দুরপাল্লার যুদ্ধের জন্য সে আমলে পাক নৌবহরের একমাত্র উল্লেখযোগ্য সাবমেরিন। গাজীর জন্ম আমেরিকায়, ১৯৪৪ সালে। পাক নৌবাহিনী ১৯৬৪ সালে আমেরিকা থেকে সামরিক সহায়তা চুক্তির আওতায় গাজীকে পায়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে গাজী কোন জাহাজ সরাসরি না ডোবাতে পারলেও যুদ্ধে কৃতিত্ত্বের জন্য মোট ১০টি পুরষ্কার পায়। তখনকার দ্বিতীয় কমান্ডার তাসনীম আহমেদ পান সিতারা-ই-জুরত পদক।

৭১ সালের মাঝামাঝি থেকেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়ায়। যুদ্ধের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনী নভেম্বর মাসে সেসময়কার তাদের একমাত্র বিমানবাহী জাহাজ আইএনএস ভিক্রান্তকে বাংলাদেশ অভিমূখে পূর্ব দিকে বংগোপসাগর অভিমুখে সরানো শুরু করে। এ খবর পাকিস্তানী নৌবাহিনী জেনে যাবার পর পালটা ব্যাবস্থা হিসেবে তারাও বংগোপসাগর অভিমুখে ভিক্রান্তকে ঠেকানোর উপযুক্ত ব্যাবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করতে থাকে। তখন বাংলাদেশের সীমানায় পাকিস্তানের যেসব নৌযান ছিল তার কোনটাই ভিক্রান্তের মত বিশাল অত্যাধুনিক বিমানবাহী জাহাজকে ঠেকাবোর মত ছিল না। তাই কতৃপক্ষকে করাচী বন্দর থেকে পুরো আরব সাগর ঘুরে বংগোপসাগরে পাড়ি দেবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য যুদ্ধজাহাজ হিসেবে গাজীকেই পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
কমান্ডার জাফর মোহাম্মদ খানের নেতৃত্বে মোট ৯২ জন নৌসেনা সমেত ৭১ এর ১৪ই নভেম্বর গাজী করাচি বন্দর থেকে তার যাত্রা শুরু করে। গাজীকে পাড়ি দিতে হবে পুরো ৩ হাজার মাইল। পাক ইন্টেলিজেন্সের কাছে পাকা খবর আছে ভিক্রান্ত তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর বংগপোসাগরের তীরে বিশাখাপতনামে অবস্থান করছে। তাই গাজীর মিশন; আইএনএস ভিক্রান্তকে ডুবিয়ে দেওয়া। সাথে সাথে বিশাখাপতনাম বন্দরের আশে পাশে মাইন ফেলে আসা যাতে ভারতীয় নৌবাহিনীর অন্য জাহাজগুলিও বন্দর থেকে বের হতে না পারে। গাজীর সফলতার সাথে পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধের গুরুত্ত্ব অনেক, কারন গাজী সফল হতে পারলে বংগোপসাগরে পাক নৌবাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে পারবে, আবার সফল হতে না পারলে ভারতীয় ভিক্রান্ত একতরফাভাবে বংগোপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করবে।
নভেম্বর এর শেষ নাগাদ গাজী পৌছে যায় বিশাখাপতনামের কাছাকাছি। তবে যেমনটি আশা করা হয়েছিল, এর মিশন আর গোপন থাকে না। ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স এর উপস্থিতি জেনে ফেলে। ভারতের ততকালীন নেভাল ইন্টেলিজেন্স প্রধান মিহির কুমার বোস পরে জানান যে গাজী থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পাক নৌঘাটিতে পাঠানো একটি মেসেজ তারা সফলভাবে ইন্টারসেপ্ট করতে পারেন। সে মেসেজের মূল বিষয় ছিল একটি বিশেষ ধরনের লুব্রিক্যান্ট অয়েল, যা শুধুমাত্র সাবমেরিনেই ব্যাবহার করা হয়। এর থেকেই ভারতীয় নৌবাহিনী সাবমেরিনের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে টের পায় ও কোনরকম ঝুকে না নিয়ে গাজীর চোখ এড়িয়ে দ্রুততার সাথে বিক্রান্তকে বিশাখাপতনাম থেকে আন্দামানে সরিয়ে নেয়। সাথে সাথে ভারতীয় নৌ কর্তাদের মাথায় খেলে যায় উলটো শিকারীকেই শিকারে পরিণত করার এক পরিকল্পনা। পূর্বাঞ্চলীয় নৌপ্রধান এডমিরাল কৃষনন সিদ্ধান্ত নেন গাজীকে ভিক্রান্তের টোপ দেখিয়ে ফাদে ফেলার। তারা ভান করার সিদ্ধান্ত নেন যে ভিক্রান্ত এখনো বিশাখাপতনামের উপকুলেই আছে। গাজীর কাছে তা প্রকাশ করতে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সিকিউরিটি সাইলেন্স ভেঙ্গে ভিক্রান্তের ছদ্মনামে একটি ভূয়া মেসেজ প্রচার করেন। তাতে ভিক্রান্তের একজন নৌসেনা তার অসূস্থ মায়ের শরীরের খবর জানতে চাচ্ছে। তাদের কৌশল কাজে দিল। গাজীর ট্রান্সমিটারে এ খবর ধরা পড়ল ও তারা শিকার ভিক্রান্তের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকল। ভারতীয় নৌবাহিনীর আরেকটি ডেষ্ট্রয়ার রাজপুতকে দায়িত্ব দেওয়া হল ভিক্রান্তের ভূমিকায় অভিনয় করার।
এ সময় ভারতীয় নৌবাহিনী কয়েকবার চেষ্টা করেও গাজীর অবস্থান বের করতে পারেনি। অবশেষে এলো ৩রা ডিসেম্বর, ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরের ঘটনা, ঠিক মধ্যরাত। ভিক্রান্তের ভূমিকায় অভিনয় করে যাওয়া ভারতীয় ডেষ্ট্রয়ার রাজপুত এমনই একটা অভিযানে বন্দর থেকে বের হয়ে আসছিল। এ সময় রাজপুতের ক্যাপ্টেন ঈন্দর সিং বন্দরের সরু প্রবেশমুখের মাত্র আধা মাইল দুরে পানিতে অস্বাভাবিক আলোড়ন দেখতে পান। তার অভিজ্ঞ চোখ এই আলোড়নকে সাবমেরিনের সম্ভাব্য অবস্থান হিসেবে হুশিয়ারি দিল। তিনি কোন ঝুকি না নিয়ে দ্রুত সে যায়গায় গিয়ে দুটো ডেপথ চার্জ (সাবমেরিন ধংসের বড় ড্রামের মত বোমা) পানিতে ফেলে ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যান। রাজপুত সেই ডেপথ চার্জের আর কোন ফল সেরাতে বুঝতে পারেনি। কিন্তু এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর বিশাখাপতনাম উপকুলে প্রচন্ড বিষ্ফোড়নের আওয়াজ শোনা যায়। সেই বিষ্ফোড়ন এতই জোরালো ছিল যে অনেক বাড়ির কাচের জানালা ভেঙ্গে যায়। যদিও কেউ তখনো বুঝতে পারেনি সেই বিষ্ফোড়নের উতস কি। সে রাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষন শুনতে বহু লোক জেগে ছিল, এই বিকট আওয়াজে তাদের ধারনা হয়েছিল ভূমিকম্প হচ্ছে।
এর দুদিন পর সকালবেলায় দুজন জেলে বন্দরের নৌদফতরে সাগর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কিছু উপকরন দেখাতে নিয়ে এলো। সেগুলির মধ্যে ছিল কোন জাহাজের লগ বই এর কিছু পাতা, একটি মার্কিন ছাপ ওয়ালা ছিড়ে যাওয়া লাইফ জ্যাকেটের অংশ যা ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাবহার করে না। সাথে সাথে ভারতীয় নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ নিশতার কে জেলেদের নির্দেশিত স্থানে পাঠানো হয়। নৌবাহিনীর ডুবুরীরা পানিতে ডুব দিয়ে সাগর তলে নাক ভাংগা অবস্থায় মৃত গাজীকে দেখতে পায়। গাজীর সাথে তার ৯২ জন ক্রু সবারই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ভারতীয় নৌবাহিনী ৩ জন পাক নাবিকের মৃতদেহ উদ্ধার করে নাবিকদের প্রচলিত উপায়ে সতকার করে বলে পরে জানিয়েছে। এটাই বংগোপসাগরর প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র সাবমেরিন ডুবির ঘটনা।
তবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কোনদিন গাজীর ডুবে যাওয়াকে ভারতীয় নৌবাহিনীর কৃতিত্ত্ব বলে স্বীকার করেনি। তাদের মতে গাজী নিছক দূর্ঘটনার স্বীকার। হয় গাজীর নিজের ১০টা টর্পেডোর কোনটা রাজপুতের ডেপথ চার্জের শক ওয়েভের কারনে বিষ্ফোড়িত হয়, অথবা নিজের পাতা মাইনের কোনটার সাথে তার নিজেরই আঘাত লেগে সে ঘায়েল হয়। প্রকৃত ঘটনা মনে হয় কোনদিনই জানা যাবে না কারন সেরাতে গাজীর একজনও নৌসেনাও সাক্ষ্য দেবার জন্য বাচেনি। যুদ্ধের পরে মার্কিন এবং রুশ দুই দেশের পক্ষ থেকেই নিজ খরচে সাগরতল থেকে গাজীকে তুলে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা ভারত প্রত্যাখান করে। ভারতীয় ভার্ষনেও কিছুটা অমিল আছে। ভারতীয় নৌ ইন্টেলিজেন্সের মিহির কুমার রায় পরে তার বইতে নিজেই স্বীকার করেছেন যে গাজী ডোবার মুহুর্তে সে অঞ্চলে কোন ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ছিল না। যদিও এডমিরাল কৃষনন তার বইতে বলেছেন যে ডেষ্ট্রয়ার রাজপূত যে অবস্থানে ডেপথ চার্জ ফেলে বলে রিপোর্ট করে ঠিক সে যায়গাতেই গাজীকে পাওয়া যায়। সময়ও মিলে যায়। গাজীর উদ্ধার করা একটি ঘড়িতে দেখা যায় যে সেটা ঠিক ১২:১৫ মিনিটে বন্ধ হয়, রাজপুত ডেপথ চার্জ ফেলে মোটামুটি একই সময়ে। অসমর্থিত কিছু সূত্রে জানা যায় যে ভারতীয় নৌবাহিনী ২০০৩ সালে আরেবার ১০ জন ডুবুরীকে সাগরতলে গাজী ডোবার যায়গায় পাঠায়। সেসব ডুবুরী রায় দেয় কোন আভ্যন্তরীন বিষ্ফোড়নের ফলেই গাজী ডুবে যায়, যদিও কারনটা জানা যায়নি।
যুদ্ধের সময়ে এ জাতীয় দাবী পালটা দাবী অনেকসময়ই বেশ ধোয়াশার সৃষ্টি করে। মজার ব্যাপার হল গাজী নিজেই ৬৫ সালের যুদ্ধে একবার এহেন দাবী করেছিল যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে গাজী ভারতীয় ফ্রীগেট ব্রক্ষ্মপূত্রকে ৪ টি টর্পেডো আঘাতের দাবী করে, তার ৩ টি নিশ্চিত ছিল বলে গাজীর তখনকার কমান্ডার জোর দাবী করেন। এই দাবীর ভিত্তিতে গাজীকে ব্রক্ষ্মপূত্র “ডোবানোর” কৃতিত্ত্বের জন্য করাচী বন্দরে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। যদিও ব্রক্ষ্মপূত্রের সেবার আসলে কিছুই হয়নি বলে পরে জানা যায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশাখাপত্তমে গাজী ডোবানো স্মরন করতে একটি বিজয় স্তম্ভ বানায়, পাকিস্তান ২০০০ সালে গাজী নামে আরেকটি নুতন সাবমেরিন তার বহরে যোগ করে। রাজপুতের কমান্ডার ঈন্দর সিংকে দেওয়া হয় বীর চক্র পদক।
তবে কারন যাই হোক, গাজী ডুবে যাওয়ার ফলে আমাদের বাংলাদেশের উপকুলের নৌযুদ্ধে পাকনৌবাহিনী যুদ্ধ শুরু হবার হবার থেকেই বস্তুত পরাজিত হয়। এরপর ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ ভিক্রান্ত সম্পূর্ণ বিনা বাধায় বংগোপসাগরে প্রবেশ করে, ভিক্রান্ত থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বন্দরে বিমান হামলা করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয় কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ ছাড়াই। চট্টগ্রাম বন্দরের হামলায় ভিক্রান্তের মাত্র একটি বিমান ভূমি থেকে ছোড়া এন্টি-এয়ারক্র্যাফটের গোলায় সামান্য আহত হয়, যদিও সেটা নির্বিঘ্নে বিমানে ফিরে আসে এবং সামান্য মেরামতির পরেই আবারো পূর্ণ কর্মোক্ষম হয়। নৌপথে পাক বাহিনীর হাই অফিশিয়ালদের পালানোর একটা গোপন পরিকল্পনাও এর ফলে বাতিল হয়ে যায়। যুদ্ধের বাকি কটা দিন ভিক্রান্ত আর ভারতীয় অন্য কয়েকটি জাহাজ মিলে ছোট বড় মোট ২৪টি পাকিস্তানী জাহাজ ডোবায়।

 

৫ মে, ১৯৭১

৫ মে, ১৯৭১ এইদিনে
 

লালপুর চিনিকলে নির্মম গণহত্যা ৫ মে নাটোর লালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সুগার মিল অবরোধের মাধ্যমে তৎকালীন প্রশাসকসহ ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শতাধিক লোককে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর শহীদদের সমাধির সাক্ষী গণহত্যাস্থলের পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ সাগর’। লালপুরবাসীর জন্য এটি একটি শোকাবহ স্নরণীয় দিন।
মুক্তিযুদ্ধের সুচনালগ্নে লালপুরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩০ মার্চ। ওই দিন লালপুরের ময়নায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সম্মুখযুদ্ধে সাঁওতাল তীরন্দাজসহ ৪০ জন বাঙালি শহীদ হন। পরদিন পাশের গমক্ষেত ও বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নেতৃত্ব দানকরী মেজর রাজা আসলামসহ কয়েকজন ধরা পড়ে। পরে তাদের নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই সঙ্গে মুক্তিপাগল জনতা, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হয়ে ২৫ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বিপর্যস্তু হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সারা দেশে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নাটোর ক্যাম্পের মেজর শেরওয়ানি খানের আশ্বাসে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের তৎকালীন প্রশাসক আনোয়ারুল আজিম যথারীতি মিলের উৎপাদন অব্যাহত রাখেন। কিন্তু পাকিস্তানি মেজর তার ওয়াদার বরখেলাপ করেন। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী মিলের সবগুলো গেটে তালা লাগিয়ে অবরোধ করে অবাঙালিদের যোগসাজশে অর্ধশতাধিক বাঙালিকে শনাক্ত করে মিলের এক নম্বর গেটসংলগ্ন পুকুরঘাটে নিয়ে যায়। তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে লাশগুলো পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। ওই দিনই পাকিস্তানি বাহিনী গোপালপুর বাজার এলাকায় আরও ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের নীরব সাক্ষী বুলেটবিদ্ধ হয়ে লাশের স্তুপের নিচে চাপা পড়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন ছয়জন। তাদের একজন বর্তমানে এই মিলের পাওয়ার হাউসের এসবিএ পদে কর্মরত খন্দকার জালাল আহমেদ। তিনি সেই বিভীষিকাময় ভয়াবহ দিনের স্নৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘একাত্তরের ৫ মে। আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টা। কাজ করছি। দুজন পাকিস্তানি সেনা আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। একজন পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বলল, ইয়ে বাঙ্গালি, চলো, মিটিং হোগা, মিটিং মে চলো। এসময় মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা মঞ্জুর ইমাম নামে একজন অবাঙালি কর্মচারী বাঙালিদের শনাক্ত করে দিচ্ছিল। সেদিনের আক্রমণে মিলের কোনো অবাঙালি যাতে মারা না পড়ে সে জন্য তাদের সবার মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা ছিল। ইতিমধ্যে মিলের প্রশাসক আনোয়ারুল আজিমসহ অন্যদের বন্দি করা হয়েছে। একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা আজিমকে লক্ষ্য করে বলে, কিসনে মেজর আসলামকে মারা হায়? তিনি বলেন, জানি না। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকেসহ আমাদের অফিসারস কোয়ার্টারের পুকুরঘাটে নিয়ে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তখনই বুঝতে পারলাম নিশ্চিত মারা যাচ্ছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাতকদের অনেকগুলো স্বয়ংক্রিয় এলএমজি একসঙ্গে আমাদের ওপর গর্জে ওঠে। গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাসে আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে পুকুরঘাট লাশের স্তুপে পরিণত হয়। তাজা রক্তে রঙিন হয়ে যায় পুকুরের পানি। আমার জ্ঞান ছিল না। আমি কীভাবে বাঁচলাম, বলতে পারব না।’
খন্দকার জালাল আহমেদ আরও বলেন, ‘একসময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি আমার মাথাটা শানের ওপর এবং দেহের অর্ধেক অংশ রক্তে রঞ্জিত পানিতে ডুবে আছে। লাশের স্তুপের মধ্যে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে জীবন্ত কাউকে খুঁজে ফিরছে আমার এক সহকর্মী মেহমান আলী। বুঝলাম তিনিই আমাকে লাশের স্তুপের মধ্য থেকে উদ্ধার করেছেন। বহু কষ্টে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম পাশে পড়ে আছে ছোট ভাই মান্নানের লাশ। সেই বীভৎস দৃশ্যের কথা মনে হলে অজও শিউরে উঠি, গায়ে কাঁটা দিয়ে।’
এই গণহত্যায় শহীদদের কয়েকজন হলেন আনোয়ারুল আজিম, সহিদুল্লাহ, গোলজার হোসেন তালুকদার, সাইফুদ্দিন আহমদ, আবুল হোসেন, আবদুর রউফ, মান্নান ভুঁইয়া, গোলাম কিবরিয়া, নুরুল হক, আজহার আলী, মকবুল হোসেন, আবুল বাসার, মনসুর, রহমান, সাজেদুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, হাবিবুর রহমান, মোসাদ্দারুল হক, মোকসেদুল আলম, আ. রহমান আমিন, মোহাম্মদ আলী, মোজাম্মেল হক, আবদুল মান্নান, ফিরোজ মিয়া, আক্তার উদ্দিন, সোহরাব আলী, আনোয়ারুল ইসলাম, পরেশ উল্লাহ, আ. মান্নান, কামাল উদ্দিন, আবুল কাসেম, আবদুর রব, শামসুল হক, আবদুল মজিদ, আবুল কালাম, নজরুল ইসলাম, আয়েজ উদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল, মোসলেম উদ্দিন, জহির উদ্দিন প্রমুখ। এ ছাড়া অন্য শহীদদের নাম পাওয়া যায়নি। সেদিন যাঁরা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন মেহমান আলী, নওসাদ আলী, খন্দকার ইমাদ উদ্দিন আহম্মেদ, আবদুল জলিল সিকদার, তোফাজ্জল হোসেন, আজের আলী প্রমুখ।
শহীদদের স্নৃতির উদ্দেশে শহীদ সাগর চত্বরে স্নৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৫ মে মিলের প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার শহীদ সাগর চত্বরে স্নৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন। তাঁর নামানুসারে গোপালপুর রেলস্টেশনের নামকরণ হয় আজিমনগর স্টেশন।
২০০০ সাল থেকে এ দিনটিকে বাংলাদেশের চিনিকলসমূহের শহীদ দিবস হিসেবে দেশের সব কটি চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা পালন করছেন। প্রতিবছর শহীদদের অত্মীয়স্বজন, মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় লোকজন ৫ মে শহীদ সাগরে সমবেত হন।
 

স্বাধিনতা যুদ্ধ ১৯৭১



বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ২৬ মার্চ ১৯৭১ এ শুরু হয়েছিল এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেষ হয়েছিল । সশস্ত্র লড়াই পূর্ব এবং প্রাশ্চাত্ত্য দেশ পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমশ দ্বন্দ্ব  সম্পর্ক তে ঘটনা, অবস্থা এবং বিষয় সম্পর্কিত এর একটি ধারার মধ্যগমন ছিল । জমি পুনর্গঠন, দেশ ভাষা, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক  অসামঞ্জস্যতা , প্রাদেশিক স্বশাসনের প্রশ্ন, পূর্ব পাকিস্তান এবং অনেক অন্যান্য  প্রশ্নের বাঁধার মুখে  ১৯৪৭ এ ব্রিটেন থেকে দেশের স্বাধীনতা থেকে পাকিস্তান সর্বদার দুই ডানার মধ্যে সম্পর্ক চ্ছিল।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের শেখ মুজিবুর রহমান রাখ তৈরি কর, আওয়ামী লীগের নেতা যেটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১৬৭ আসন বাইরে এর ১৬৯ বন্টন কর থলিয়েছিল, পাকিস্তান জাতীয় বিধানসভাতে পূর্ব পাকিস্তান এবং সংখ্যাগুরু নেতার জনগণের একমাত্র মুখপাত্র। কিন্তু পাকিস্তান অসামরিক এবং সামরিক শাসক  সংখ্যাগুরু নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার অনূষ্ঠানে অধিকার স্থানান্তর করতে অস্বীকার করেছিল। শেখ মুজিব অসঙ্গত বাসস্থানের জন্য তাকে চাপ রাখাতে ত্যাগ করতে ও অস্বীকার করেছিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ এ মুজিবের ঐতিহাসিক সম্বোধন করা পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কে এই বিন্দুটি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার তৈরি করেছিল ।

 তারপর অসামরিক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এসব বিষয় স্থিরসঙ্কল্প করতে মুজিব এবং ইয়াহিয়া এর মধ্যে ইতিমধ্যে কথা বলে শুরু করে । কথাবার্তা ধরার সময়, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা দেশের ওপর একই সময় হত্যা যথেচ্ছাপূর্বক নিস্পাপ অসামরিক ব্যাক্তি সমস্তে বাংলাদেশ এবংতে আরও বেশি সৈন্য আনছিল।

 
এইটি পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান যে তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রার্থীদের অধিকারের ওপর হাতের সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় ছিল। মুজিবের কোনও কথাই তারা আমলে নেয়নি, গণহত্যা শুরু হয়েছিল, ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর মধ্যরাত্রি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নরক তান্ডব ভেঙ্গে পড়ে। পশ্চিম বাংলাতে দেশীয় চাকুরীরত  সৈন্যগন তারপর পাকিস্তান সসস্ত্র শক্তিসমূহ এবং একক  রক্ষীবাহিনী শক্তিসমূহ জনগণের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তাদের ভ্রাতৃত্ব তাৎক্ষনিকভাবে ঘোষণা করেছিল।

বাংলাদেশের স্বাধিনতা যুদ্ধের দলিল পত্র ৮ম খন্ড – পাতা ১৮২

পয়লা বৈশাখে পাকি বাহিনী আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। তারা আসার পরে ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। স্হানীয় অবান্গালীরা এ সময় লুটপাট করে। পলায়নপর লোকজনদের পাক বাহিনী এ সময়ে হত্যা কর। এর দুই মাসে মধ্য শান্তি বাহিনী গঠিত করা হয়। শান্তি বাহিনীর সাথে পাক মিলিটারীর যোগাযোগ ছিল। শান্তি বাহিনীর মদতে এবং পাক বাহিনীর উতসাহে পরবর্তীতে স্হানীয় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকাররা পাক মিলিটারির জন্য গ্রামে গ্রামে রেকি করত। লোকজনকে ধরে নিয়ে পাক মিলিটারীকে দিত। অসহায় মেয়েদেরকে রাজাকার বাহিনী ধরে ধরে পাক মিলিটারিদের দিয়েছে।

রাজাকাররা আর অবান্গালীরা জোর করে ভয় দেখিয়ে প্রচুর হিন্দুকে মুসলমান করেছে। আমি নিজেও উক্ত শিকারে পরিনত হয়েছিলাম। পুরা গ্রামে ১৩ টি হিন্দু পরিবারকে জোর পুর্বক মুসলমান করে রাজাকাররা আর অবান্গালীরা। এ সময় তারা মনদির ভেন্গে ফেলেছে এবং বিগ্রহ ফেলে দেয়।

স্বাক্ষর
দীপক প্রসাদ গুপ্ত
গ্রাম -পশ্চিম টেংরা
থানা-ইশ্বরদী
জেলা – পাবনা
( ৭১ এর মানচিত্র অনুযায়ী)

পাদটীকা-জামাত ইসলামী বাংলাদেশ ততকালীন শান্তি বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী গঠনের অগ্রগামী ভুমিকা পালন করে। যুদ্ধ অপরাধের প্রচুর অপরাধ জামাত এ সময় পাকিস্তানের মিলিটারী সহযোগীতায় করে।

আমার বিশ্লেষনে বঙ্গবন্ধু দেরি কইরা ফালাইছিলেন সমূল কাঠামোগত পরিবর্তনের আবশ্যিক প্রয়োজন বুঝতে আর একশন নিতে খুব সম্ভবত সেই দেরীর কারন আমাদের সল্পস্থায়ি স্বাধিনতা যুদ্ধ ও সেইসময় তার বন্দিত্ত‌্য যা তাকে ভবিষ্যত স্বাধিন রাষ্ট্রের কাঠামোগত প্রথিষ্ঠানগুলি স্বমন্ধে গভীর চিন্তা ভাবনা করার ও সময় বা সুযোগ দেয় নাই। এইটাই আমাদের প্রস্ততিহিন স্বল্পস্থায়ি স্বাধিনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক রুঢ় বাস্তবতা, আমদের স্বাধিনতার প্রথম প্রহেরের প্রস্তুতিহিনতার আর ভুলগুলির মূল কারন। কারন যাই হোক, নির্মম ইতিহাসের চাকা ঘুরে শুধু সব বাস্তবতার সমষ্টিক প্রভাবে – ততোদিনে একদিকে তার অবিসম্বাদিত রাজনৈতিক বেস দুর্বল হইয়া গেছে আর অন্যদিকে পুজিবাদি সম্রাজ্যবাদী শক্তি, তাদের দেশীয় দোসররা, তাদের তাবেদার ও এজেন্ট  কালা উপনিবেশিক রাষ্ট্রিয় প্রথিষ্ঠানগুলি এবং স্বাধিনতা বিরধীরা সঙ্ঘঠিত হইয়া শক্তি সঞ্চয় কইরা ফালাইছে। তার উপরে ছিল নিজের দলের মধ্যে ঘাপ্টি মাইরা থাকা সবচেয়ে ভয়ানক বিভীষনেরা, সুবিধাবাদিরা আর চিকারা, যারাই ছিল দলে বিপুল সংখাগরিষ্ঠ আর বঙ্গবন্ধু এত বড় পরিবর্তনের ঊদ্যোগ নিতে গেছিলেন পুজিবাদি সম্রাজ্যবাদী শক্তির সহজাত তাবেদার ও এজেন্ট অই কালা উপনিবেশিক রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাথা আগে না নামাইয়া, তাদের সুতিকাগার জেলা প্রসাশন উপড়াইতে গিয়া সেই সব ভুলেই ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসি বাঙ্গালি প্রান দিলেন – ৫% জিতলো, আর বাকি ৯৫% বেকুব আর স্বাধীন হইতে পারলো না, খালি বার ঘুইরা মাগুড় চ্যাং হইতে লাগলো।
বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সমধানের বিষদ পরিকল্পনা নিয়া অনেক দ্বিমতই থাকতে পারে। কিন্তু তিনি আর যেই ভুলই কইরা থাকেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বাকশাল করেন নাই। তখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতাতো তার হাতেই ছিল – আমাগো স্বার্থ বিসর্জন দিয়া পুজিবাদি সম্রাজ্যবাদি শক্তির সাথে হাত মিলাইয়া তাগো দলে ভিরা গেলে তারাই তাদের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা চিরস্থায়ি কইরা দিত – যেমন দিছিল কঙ্গোর মবুতুরে, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোরে আর ইরানের শাহে্‌র মতো আরো অনেকেরে।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুই প্রমান কইরা দেয় যে তিনি সঠিক যায়গায়ই হাত দিছিলেন, তবে দেরি কইরা ফালাইছিলেন আর প্রস্ততি নেন নাই – তিনি সঠিক যায়গায়ই হাত দিছিলেন বইলাই এবং এই নিয়া তিনি কোনো আপোষ করবেন না এইটা বুঝতে পাইরাই তাকে হত্যা করা হইছিল – আবীর আহাদেকে দেওয়া তার সাক্ষাতকারে, বঙ্গবন্ধুর নিজের জবানিতেইে এইটা পরিস্কার যে সব বিপদ সব প্রতিকুল অবস্থা সবকিছু বুইঝাই ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসি বাঙ্গালি এই রিস্ক নিছিলেন বেপরোয়া সাহসিকতায়, ৯৫% বেকুবদের সত্যিকারভাবে স্বাধীন করার কোনো সহজ পথ নাই এইটা বুঝতে পাইরাই –
বঙ্গবন্ধুর বাকশালের ধারনায় হয়তো অনেক কিছুই ভুল ছিল, দুর্বলতা ছিল। অনেক কিছুই হয়তো প্রথমিক পর্যায়ে সরাসরি সফল হইতো না, একধাক্কায় তিনি খুব সম্ভব সফলও হইতে পারতেন না, ৭০ দশকের সমাজতন্ত্রের ধারায় হয়তো অর্থনৈতিক স্থবরিতা কাটতো না কিন্তূ পরিক্ষা নিরিক্ষা, ভুল ভ্রান্তি করা ছাড়া কেউ কি কোনোদিন সমাজ বদলানোর মতো বিশাল এবং জটিল মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারছে – কেউ পারে নাই সেই সাহস যারা কইরা উঠথে পারে না তারা কোনোদিনই সমষ্টিগত ভাবে তাদের অবস্থা বদলাইতে পারে না, সমষ্টিগত ভাগ্য ফিরাইতে পারে না। বঙ্গবন্ধু তখন তার প্রথম  ধাক্কায় সফল হইলে, তার বাকশাল পরিকল্পনার সব দুর্বলতা, সব ভুল ছাপাইয়া প্রথমেই একটা বিশাল অর্জন হইয়া যাইতো – ঊপনিবেশিকতা, কালা উপনিবেশিক প্রথিষ্ঠানগুলির আর উপনিবেশিক দাস মানসিকতার কবর দিয়া ৯৫% বেকুব তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রতমবারের মত নিজস্ব ক্ষমতায়নের দিকে আগাইয়া যাইত (বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায় “ প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, ষ্টিলফ্রেম বা গতানুগতিক টাইপড চরিত্রকে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেবার ব্যাবস্থা নিয়েছি। সরকারি কর্মচারিরা এখন থেকে জনগনের সেবক।“) – নিজেদের পায়ে দাড়াইয়া সমষ্টিগত ভাবে নিজেদের সমস্যাগুলি বুঝতে শুরু করতো, নিজেদেরভাগ্য ঘুরাইতে অংশ নিতে শুরু করতো। পরিক্ষা নিরিক্ষা, ভুল ভ্রান্তি করতে করতেই আমরা আস্তে আস্তে শিখতাম, আত্মবিশ্বাস অর্জন করতাম।
এই ভাবেই কি চীন, ভিয়েতনাম দীর্ঘ পরিক্ষা নিরিক্ষা, ভুল ভ্রান্তি করতে করতেই ঘুইরা দাড়ায় নাই? হঠাৎ কইরা কোনো ম্যাজিকের বলে তারা ঘুইরা দাড়ায় নাই – দীর্ঘ সামাজিক পরিক্ষা নিরিক্ষার পর এইটা তাদের সমষ্টিগত সুপ্ত শক্তির সমন্নিত বিকাশের ফল – সমষ্টিগত ভাবে নিজেদের সমস্যা অনুধাবন ও মোকাবেলা করার ফল
তারপর পয়ত্রিশ বছর ধইরা বার বার ঘুইরা মাগুড় চ্যাং হইতে হইতে আমরা অর্থনৈতিক আর সামাজিক সমস্যার মহাপর্বত জমা করলাম আর অন্যদিকে সাড়ে সাত কোটি বেকুবের সংখা বাইরা দাড়াইল সাড়ে ষোলো কোটি বেকুবে। পিছনে সমস্যার মহাপর্বত, মাঝখানে সাড়ে ষোলো কোটি বেকুব আর সামনে সমস্যার মহাসমুদ্র ধাইয়া আসতেছে এই হইতাছে আমাদের এখনের সার্বিক অবস্থা –
বঙ্গবন্ধু সেইসময় সফল হইলে কি আমাগো বর্তমান অবস্থা অন্যরকম থাকতো? ধাইয়া আসা সমস্যার মহাসমুদ্র  অবধারিত ভাবেই আসতো, কেওই কিছু করতে পারতো না। তবে তিনি যদি সত্যিকারভাবে সাধারন মানুষের ক্ষমতায়ন করতে পারতেন, তৃনমুল থাইকা তাদেরকে তাদের নিজেদের সমস্যা উপলবদ্ধিতে ও তার মোকাবেলায় সম্পৃক্ত ও সংঘবদ্ধ করতে পারতেন, তাইলে আমাদের পিছনের সমস্যার মহাপর্বত তৈরী হইতো না, বা হইলেও অনেক ছোটো থাকতো আর সেইসাথে বর্তমান জনসংখাও অনেক কম থাকতো – আমরা সম্ভবতো ধাইয়া আসা সমস্যার মহাসমুদ্র মোকাবেলায় অনেক সংঘঠিত অবস্থানে থাকতাম – হয়তো, কি হইতে পারতো সেই কথা বইলা আর কি লাভ? লাভ হয়তো একটাই – কি ভাবে আমরা আমাগো বর্তমান অবস্থায় আইসা পৌছাইলাম তার গভীর সূত্র বোঝা, আর তা থাইকা শিক্ষা নিয়া যদি ভবিষ্যতের মোকাবেলায় কাজে লাগাই।
নিচে বাংলাদেশের ২০৫০ সাল নাগাদ অতি সম্ভাব্য দুইটা মানচিত্র।
সমুদ্রের এই মোটামুটি অবধারিত অগ্রাসন রাতারাতি হঠাৎ কইরা ২০৫০ সালে ঘটবে না –  প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মিনিটে, প্রতি সেকেন্ডই সমুদ্র আগাইয়া আসতেছে – প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মিনিটে, প্রতি সেকেন্ডই সমুদ্র আগাইয়া আসতে থাকবে। এখন সমুদ্রের এই অবসম্ভাবি অগ্রাসনের সাথে নিচের টেবিলের  জাতিসঙ্ঘের ২০০৮ সালে আপডেট করা ১৯৫০-২০৫০ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রোজেকশন মিলাইয়া দেখেন।


একদিকে দেশ ছোটো হইতেই থাকবে, ফসলের জমি কমতে থাকবে – আর অন্যদিকে আমাদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।  – একবার ভাবেন সেই ভইয়াবহতা, পিছনের পঞ্জিভুত সমস্যার মহাপর্বতের চক্রবৃদ্ধি হার বৃদ্ধি আর এক ত্রিতিয়াংশ ছোটো হওয়া দেশে এখনকার দুই তৃতিয়াংশ খাদ্য উৎপাদনের মতো চাষের জমি নিয়া ২২ কোটি মানুষের বাচার বেপরোয়া চেষ্টা।
আমাগো ভবিষ্যতের এই ভয়াবহ বাস্তবতা কোনোমতে শুধু বাইচা থাকার চেষ্টায় নিরন্তর ব্যাস্ত সাধারন মানুষের পক্ষে পুরাপুরি না বুইঝা উঠারই কথা। বাইরের দুনিয়ার, বিশেষ কইরা উন্নত বিশ্বের মোটামুটি সবাইই জানে, এমন একটা সপ্তাহ যায় না যখন সি এন এন বা অন্য ইন্টারন্যাশনাল টিভি চ্যানেল এই ব্যাপারে কোনো রিপোর্ট দেখায় না আমাগো শাসক শ্রেনীরতো এগুলি না দেখার না জানার কথা না। কিন্ত তাগো ভাব সাব দেইখা মনে হয় তারা এইস্বমন্ধে জানলেও, ভবিষ্যতের এই ভয়াবহ বাস্তবতা এখনো তাদের বোধগম্য হয় নাই – নাইলে তারা যেইভাবে চলতাছেন সেইভাবে চলতেন না। এইবার আর ৫% জিতবে না, ১০০% ই হারবে, ভয়াবহ ভাবে হারবে। তবে ৫% হারবে সবচেয়ে ভয়াবহ ও নির্মম ভাবে, তাদের বিছিন্ন স্বর্গগুলি থাইকা সরাসরি হঠাৎ জাহান্নামে প্রবেশের মাধ্যমে।
খালি একবার ভাইবা দেখেন বর্তমান পর্যায়ের সামাজিক বইষম্যের প্রতিক্রিয়ায় যেই পঞ্জিভুত ক্ষোভের যেই বহিপ্রকাশের যেই অশনী সংকেত আমরা দেখতেছি  বি ডি আরের নৃশংসতা সহ আরো নিত্যদিনের রাজনৈতিক আর অরাজনৈতিক নির্মম সহিংসতায়, সেই পঞ্জিভুত ক্ষোভের  বহিপ্রকাশ কোন ভয়াবহ বিস্ফোরোনের পর্যায়ে যাইয়া পৌছাইবে, যখন ছোটো হইতে থাকা দেশে আরো কয়েক কোটি অতিরিক্ত মানুষ বেপরোয়াভাবে খালি বাইচা থাকার চেষ্টা করবো –
·      যেই ঢাকার জমি, বাড়ি, ফ্লাট আর সব দালান কোঠার দাম দুর্নিতি আর ঘুষের টাকার তোড়ে সোনার দামের চেয়ে বেশি হইছে সেই ঢাকা পরিত্যাক্ত হইয়া যাইতে কি আর বেশি দিন বাকি আছে? ঢাকার জমি, বাড়ি, ফ্লাট আর সব দালান কোঠার দাম পানির দামেও বিক্রি না হয়ার দিন কি খুব দূরে? খাওয়ার মতো পানির দাম ততোদিনে অনেক মাঙ্গা হইয়া যাইবো।
অবশ্য এর মধ্যে নিজেদের মধ্যে ভইয়াবহ হানাহানি, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, আর্সেনিক এবং আরো অনেক প্রাকৃতিক প্রতিশোধের মাধ্যমে আমাদের সংখ্যা পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে আবার ৭-৮ কোটিতেও ফিরা যাইতে পারে – দেশের বর্তমান অবস্থায় সেই ভয়াবহতার সম্ভবনাই বেশি। হয়তো দুইশ বছরেরও আগে লেখা মালথ্যাসের থিওরির চরম বাস্তব বিকাশ এই অভাগা দেশেই ঘটবে।
আমাগো শাসক শ্রেনীর হুশ হওয়ার সম্ভবনা নাই বলতে গেলে। তারা হরিলুটে আর তাদের সাজানো মনগড়া কাইজ্জায় এমন ব্যস্ত যে শেষ সময় আসার আগে তাগো হুশ হইবো না। আর হুশ আসলেও তাগো মতো মাজাভাঙ্গা দুর্নিতিবাজগো এই মহাপ্রলয়ের বিরুদ্ধে  লড়াই দেওয়ার মতো সাহস ও সক্ষমতা কোনোদিনই হইবো না –
তাইলে কি আমাগো অস্তিত্ত্য বাচানোর আর কোনোই আশা নাই? হয়তো একটাই আশা আছে – ইতিহাস বলে চরম দুঃসময় চরম দুর্যোগ অনেক সময় সেইরকম ক্রান্তিকালের প্রচন্ড সাহসি এবং সক্ষম নেতার জন্ম দেয় – সেই সম্ভবনাই আমাগো একমাত্র আশা ।