RSS

সাপ্তাহিক ২০০০ : ১৯৭১-অতীত-একমাত্র-সত্য

15 আগস্ট

কাওসার আহমেদ চৌধুরী

‘১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে একদিন পাকিসত্মানকে তিন তালাক দিয়ে আমরা যখন যুদ্ধে নেমে পড়লাম, আকাশে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, সবাই জানেন, আমাদের বয়স তখন ১৪ থেকে ৭৪; রক্ত বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হলেও তাজা, টাটকা, গরম আর জীবাণুমুক্ত।’
কবিতার এই লাইনগুলো লিখেছিলাম ১৯৯৫-এর এপ্রিলে। তেমন বিশাল কিছু ব্যাপার নয়, তবে আজ এই ২০১১-এর ২৫ এবং ২৬ মার্চ যখন আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে- তখন কবিতার কথাগুলো আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লেখা ঘটনার নোটের মতোই মনে হচ্ছে। আপনার-আমার অনেকেরই চোখের ওপর দিয়ে পার হয়েছে ১৯৭১। আমরা অনেক কিছুই দেখেছি, শুনেছি এবং করেছি। এক আয়ুতে আমরা জেনেছি পরাধীনতা কী, স্বাধীনতা কী। স্বদেশে বাস করেও বছরের পর বছর ধরে আমরা পেয়েছি দাসত্বের অপমান। দেখেছি ড়্গুদ্র একটি গোষ্ঠী বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠীকে কীভাবে জুতের তলায় চেপে ধরে রাখে যুগের পর যুগ। আমরা দেখেছি মানুষের কাপুরুষতা, বীরত্ব, ঘৃণা, হিংস্রতা, ভালবাসা এবং পূর্ণ যতিচিহ্নের মতো আকস্মিক মৃত্যু। আর দেখেছি বাঁশের ডগায় ঝোলানো চাঁদ-তারা মার্কা একটি অলিক কল্পনার পতাকা কী মর্মান্তিকভাবে প্রতারিত করেছে আমাদের এই বাঙালি জাতিকে। আমার একটু পরিচয় সঙ্কট আছে। আমি আজো ঠিক জানি না, আমি সত্যিকার অর্থে কী কাজ করি। কিন্তু যতই পরিচয় সঙ্কট থাক না কেন একটা পরিচয় আমার কাছে খুব স্পষ্ট, সেটা এই যে, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যত ক্ষুদ্রভাবেই হোক, যত তুচ্ছভাবেই হোক, এই মুক্তিযুদ্ধের ব্যক্তিগত প্রচুর ঘটনা আমার কাছে আছে- যা স্বাধীনতার এই চল্লিশ বছর পর বলতে গেলে আজ প্রথম প্রকাশ করছি।
পাঠক, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। চল্লিশ বছর কেন- একটা অতীত যদি চল্লিশ কোটি বছরও পার হয়ে যায় তবুও সেটা নিরেট সত্য। এই অতীতের ভালো দিক থাকতে পারে, মন্দ দিক থাকতে পারে, কিন্তু সেটা এমন এক সত্য যা কখনো মুছে ফেলা যাবে না। তবে আজ যা বলছি তার মধ্যে ভুল কিছু কিছু থাকতে পারে কিন’ মূল যে কথাটা- বাংলাদেশ শেষ পর্যনত্ম মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, এটা কোনোভাবেই ভুল হতে পারে না। মূলত আমি ছবি আঁকি, গান-নাটক লিখি, কবিতাও কিছু কিছু লিখি। এই ‘কিছু কিছু’ শুরু হয়েছিল খুব ছেলেবেলায় সব বাঙালি শিশু-কিশোরের মতো। আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম অগ্নিযুগের বিপস্নবীদের কাহিনী পড়ে। তখন আমি প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। এক বছর বয়স হওয়ার আগেই মা হারিয়ে বোনের কাছে থাকি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে।
তখন দেশটা ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানই যে আমার দেশ সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে স্কাউটিংয়ে যোগ দিলাম আমার জন্মশহর সিলেটে। ওখানে আমাদের শেখানো হলো, আমাদের রক্তে মিশিয়ে দেওয়া হলো একটা ভুল ইতিহাস। যার পেছনে অনেক প্রতারণা ছিল, অনেক কিছু ছিল। যা বোঝার বয়স আমার তো নয়ই, আমার অগ্রজদেরও ছিল না। আমার বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন। মুসলিম লীগারদের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল, যারা পাকিসত্মান চায়। কিন্তু তিনি কখনো আমাকে বা আমার ভাইবোনদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন না। তিনি বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকা পড়তে উৎসাহিত করতেন। তার সঙ্গে কথাবার্তা খুব কম হতো। যেটুকু হতো তাতে তিনি বলতেন ‘পড়ো’। পড়ার অভ্যাসটা ছিল পরিবারের সবার মধ্যেই। কিন্তু তখন যা পড়ছি তা মূলত পাকিস্তানের ইতিহাস। তখন একজন ভাড়াটে আত্মজীবনী লেখক ছিলেন, হেক্টর বলিথো। তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং টাকার বিনিময়ে সেসব দেশের নেতাদের জীবনীগ্রন’ লিখে দিতেন। তিনি ‘জিন্নাহ্‌’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই বইটি পড়ে। ভেবেছিলাম, এই তো নেতা; নেতা তো এ রকমই হবে। এরও অনেক পরে আমি রেডিও পাকিস্তান থেকে কবিতা পড়েছিলাম জিন্নাহ্‌র জন্মদিনে। এগুলো আমার কাছে দোষের বা অপরাধের মনে হয়নি, আজো মনে হয় না।
সত্যের মধ্যে কোথাও ভ্রান্তি ছিল। সেই ভ্রান্তির জন্য অন্য কেউ দায়ী ছিল। কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৫ বছর বয়সে আমি বাংলাদেশ চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়তে এলাম। এ রকম কচি বয়সেও আমার একটু করে চোখ খুলতে লাগল। সমবয়সী এবং বয়স্ক বন্ধুদের সঙ্গে, শিক্ষকদের সঙ্গে তর্ক করতে লাগলাম। চারুকলা ইনস্টিটিউটে সে পরিবেশটা ছিল। একদিন চারুকলা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষক, খুব ভালবাসার শিড়্গক- আমাদের একটা ঠাট্টা, যাকে বলে জোক বললেন। ঠাট্টাটা হলো এরকম- পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাতে আছে সবুজ জমিন, ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে যা একটি প্রতীকী রং প্রতীক হিসেবে। আর তার ওপর চাঁদ-তারা। ওটাও তাই। আর একটা অংশ সাদা। শিড়্গক বললেন, ‘দেখো, এই সাদা অংশটুকু রাখা হয়েছে সংখ্যালঘুদের প্রতীক হিসাবে, সংখ্যালঘুদের পবিত্র দায়িত্ব নিয়েছে পাকিস্তান। এই সাদা অংশটি তারই ইঙ্গিত পাকিস্তান জন্ম নেয়ার পর জিন্নাহ্‌র বক্তব্য আমার মনে পড়ল যে, ‘এখন থেকে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বলে কেউ নেই, সবাই পাকিস্তানি।’ তার বক্তব্যে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছিল।
শিক্ষক তার ঠাট্টার শেষাংশে এসে বললেন, ‘যেখানে দায়িত্ব নেয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের রক্ষার, এই পতাকার বাঁশটা কিন্তু সেই অংশেই দেওয়া হয়েছে। বাঁশটা অন্য দিক দিয়েও হতে পারত। তোমরা বুঝেছ কেন এটা করা হয়েছে? আমার এই তামাশা বুঝতে তোমাদের সময় লাগবে।’ শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয় গোটা বাঙালি জাতির সঙ্গেই আসলে সংখ্যালঘুর মতো আচরণ করা হচ্ছিল। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সেসব ইতিহাস জানেন, আমরা কীভাবে শোষিত হচ্ছিলাম, সেনাবাহিনীতে আমরা বড় পদে যেতে পারতাম না। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৫৭ সালে আমি যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ বেড়েছিল। তখন আমি স্কাউটে। স্কাউট থেকে ছেলেদের নেয়া হলো থ্রিনট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ দিতেন পুলিশের হাবিলদাররা। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একজন বেলুচ প্রশিক্ষক হাবিলদার ছিলেন, তিনি মাঝে মধ্যে হেসে বলতেন, ‘তোরা কোটি কোটি বাঙালি, আমাদের বেলুচদের হাতে যদি মাত্র ৩শ রাইফেল থাকত তাহলে আমরা বেলুচকে স্বাধীন করে ফেলতাম। আসলে তোরা কোনো কাজের না।’ তাহলে দেখা যাবে, ১৯৫৭ সালেও পাকিস্তানের ভেতরের ব্যাপারটা এ রকম ছিল। বেলুচরা ভেতরে থেকেও কিছু করতে পারছিল না। আমরা সেদিক থেকে কিছুটা খোলা জায়গায় ছিলাম। সেই বেলুচের কথা শুনে প্রশ্ন করার সাহস অবশ্য আমাদের কারো ছিল না, বেলুচরা কেন স্বাধীন হতে চায়? পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কৌশলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিশে যখন সীমান্ত পার হলাম- তখন ওদের অন্তর্কলহটা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল আমার কাছে। প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য তখন ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম। দেখতে আমাকে পাকিস্তানিই মনে হতো। চেহারাটাও অনেকটা ওদের মতোই ছিল। অনর্গল উর্দু বলতে পারতাম। দেখেছি, পাঞ্জাবি অফিসারের বোতল এবং অন্য জিনিসপত্র পাঠান কিশোর সৈনিকের হাতে ছিল- বহন করার জন্য। কিছু দূর যাওয়ার পর সেই সৈনিকটি প্রতিবাদ পাঞ্জাবির জিনিস বহন করতে চায় না। এ রকম প্রতিক্রিয়া যদি তাদের মধ্যেই হয়ে থাকে তবে তো বাঙালির মধ্যে বহুগুণ বেশি হওয়ার কথা। যুদ্ধে যেতে যেতে এই সত্যটা আমার কাছে স্পষ্টতর রয়েছে। পরবর্তীকালে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি ঢাকাতেই ছিলাম, সেক্টর-২-এ। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনা আমি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই, যেগুলো পাঠকের মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো দিতে পারবে। আপনাদের মধ্যে যারা বয়সে তরুণ-তাদের বলছি, আপনারা অনেকেই অনেক কিছু জানেন। কিন্তু নানা ব্যস্ততা, পড়াশোনার চাপ আর রুজি-রোজগারের চাপের কারণে নতুন প্রজন্মের যাদের ইতিহাস পড়ার সময় নেই, তারা যদি এ লেখা পড়ে কিছু জানতে পারেন তবেই আমার এ লেখা সার্থক হবে। সাপ্তাহিক ২০০০-এর পাঠকের কাছে আমি ৪০ বছর আগের সেই রক্তঝরা, ত্যাগ আর মহিমার দিনগুলোর কথা বলে যেতে চাই। অনেকেই বলেছেন অনেক কিছু, কিন্তু আমি মনে করি না যে, সব ঘটনা শেষ হয়ে গেছে, সব বলা হয়ে গেছে বা সময় শেষ হয়ে গেছে।

 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান